দাবাগুরু রাণী হামিদ: আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশি নারীদের অনন্য অনুপ্রেরণা

আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের ভূমিকার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার শতাব্দী ২১ শতক। সেখানে বাংলাদেশি নারীদের উপস্থিতি অনেকটাই সীমিত। এরপরেও বিস্তৃত এই মঞ্চে অল্প যে দুয়েকটি পদচিহ্ন পড়ছে তা অনেকখানি এগিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বর্ষিয়ান দাবাড়ু রাণী হামিদ। ৮০ বছর বয়সেও এই দাবাগুরু নিজের সপ্রতিভার সাক্ষর রেখে বিশ্ব দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছেন। ৪০ বছরের সুদীর্ঘ ক্রীড়া জীবনে দাবা খেলাকে ঘিরে তার নামের পাশে যুক্ত হয়েছে একাধিক বিশেষণ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নারী মাস্টার, কমনওয়েলথের শীর্ষ দাবা খেলোয়াড় এবং ব্রিটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন। চলুন, রাণী হামিদের একজন সফল দাবাড়ু হয়ে ওঠার গল্প এবং তার অর্জনগুলো সম্বন্ধে বিশদ জেনে নেওয়া যাক।
ভালো নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন, পরিজনদের কাছে যিনি পরিচিত রাণী নামে। তার জন্ম ১৯৪৪ সালের ১৪ জুলাই ব্রিটিশ ভারতীয় শাসনামলে আসাম প্রদেশে (বর্তমান সিলেট)। বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী ছিলেন তৎকালীন সময়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা মোসাম্মাৎ কামরুন্নেসা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।
শৈশবে রাণীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকানন গার্লস হাইস্কুলে। যেখানে তিনি সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেনিতে ভর্তি হয়েছিলেন। বাবার চাকরির সুবাদে কয়েক বার স্কুল বদলের পর অবশেষে ১৯৬০ সালে সিলেট বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রি পরীক্ষা দেন।
১৯৫৯ সালে তার বিয়ে হয় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং ক্রীড়া সংগঠক এম এ হামিদের সঙ্গে। সেই থেকে তিনি হয়ে যান রাণী হামিদ এবং পরবর্তীতে এই নামেই সবার কাছে পরিচিত হন।
হামিদ দম্পতির জ্যেষ্ঠ ছেলে কায়সার হামিদ ছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একজন ফুটবল খেলোয়াড়। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তিনি অধিনায়কত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের। মেজো ছেলে সোহেল হামিদ ছিলেন জাতীয় স্কোয়াশ চ্যাম্পিয়ন। কনিষ্ঠ ছেলে শাজাহান হামিদ ববি ছিলেন জাতীয় হ্যান্ডবল এবং ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল লীগ খেলোয়াড়। সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান একমাত্র মেয়ে জাবিন হামিদ।
১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কোয়ার্টারে থাকার সময় হামিদদের প্রতিবেশী ছিলেন জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন ড. আকমল হোসেন। তার সহযোগিতায় ১৯৭৬ সালে মহসিন দাবা প্রতিযোগিতায় নাম লেখান রাণী। এটিই ছিলো তার জীবনে প্রথমবারের মতো বড় কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ।
১৯৭৭ সালে নারীদের জন্য প্রথম পৃথক দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নবদিগন্ত সংসদ দাবা ফেডারেশন। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংগঠনটি ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালেও একই আয়োজন করে, আর তিনবারই তাতে চ্যাম্পিয়ন হন রাণী।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত টানা ৬ বছর জাতীয় শিরোপা ছিল রাণীর দখলে। ১৯৭৯ সালে তিনি ঢাকার একটি ওপেন কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। আর তার জন্য এটিই খুলে দিয়েছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দুয়ার। দেশের বাইরে তার প্রথম পা রাখেন ১৯৮১ সালে ভারতের হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ১৯৮৩ সালে তিনি হেলেন মিলিগানের সঙ্গে যৌথভাবে ব্রিটিশ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন। ইউরোপের প্রসিদ্ধ দাবা প্রতিযোগিতাটিতে এটি ছিল প্রথম এক বাংলাদেশি নারীর শিরোপা জয়। এরপরের ১৯৮৫ এবং ১৯৮৯-এর বৃটিশ শিরোপা তিনি এককভাবেই জিতেছিলেন।
১৯৮৪ সালে তিনি যোগ দেন বিশ্বের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন দাবা প্রতিযোগিতা ওয়ার্ল্ড দাবা অলিম্পিয়াডে। গ্রীসে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে ওপেন সেকশনে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের থেকে আগত বিশ্বের ৪র্থ গ্র্যান্ডমাস্টারের। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই খেলাটি রাণীর দাবা ক্যারিয়ারে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেখানে তাকে এক মজার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রথম দর্শনে তাকে দেখে খেলার মূল প্রাঙ্গনে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। তাকে বলা হচ্ছিল যে, এই জায়গাটি শুধুমাত্র পুরুষ খেলোয়াড়দের জন্য। মূলত এই পুরুষ খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধেই যে তিনি ওপেন সেকশনে খেলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাষাগত সমস্যার কারণে এই বিষয়টি বোঝাতে যেয়ে তার অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল।
রাণী ছিলেন দাবা অলিম্পিয়াডের ৫ম মহিলা, যিনি তার নিজ যোগ্যতায় অলিম্পিয়াডে জাতীয় পুরুষ দলে স্থান পেয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ওমেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার (ডব্লিউআইএম) খেতাব।
১৯৮৯-এ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় কাসেদ আন্তর্জাতিক মহিলা দাবা, যেখানে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন রাণী। ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ স্পোর্ট্স প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য তাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে দিল্লিতে আয়োজিত কমনওয়েল্থ দাবা’য় দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য তিনি লাভ করেন স্বর্ণপদক লাভ করেন। এরপর রাশিয়ায় দাবা বিশ্বকাপ ২০১৮-তে জোনাল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তিনি ‘জার্নালিস্ট চয়েস অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হন।
২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে ২০ বারের মতো বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা শিরোপা জিতেন রাণী। এটি এখন পর্যন্ত অর্জিত দেশের সর্বাধিক নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জয়।
বিশ্বের তুখোড় তুখোড় দাবাড়ুদের স্বর্গরাজ্য হলো দাবা অলিম্পিয়াড, যে প্রতিযোগিতা প্রতি দুই বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়। এই আয়োজনের সংগঠক আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন, যার ফরাসি ভাষায় সংক্ষিপ্ত রূপ ফিদে। এই ফিদে অলিম্পিয়াড টুর্নামেন্ট পরিচালনা এবং খেলাগুলো কোন দেশে হবে তা নির্ধারণ করে থাকে। বিভিন্ন দেশের ফিদে-স্বীকৃত দাবা সংস্থা থেকে কেবল একটি দল অলিম্পিয়াডে প্রবেশ করতে পারে। প্রতিটি দলে চারজন নিয়মিত এবং একজন রিজার্ভ খেলোয়াড় নিয়ে মোট পাঁচ সদস্য থাকে।
ফিদের অধীনে নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা প্রতিযোগিতা, যেটি ওমেন্স চেস অলিম্পিয়াড নামে পরিচিত। বিভিন্ন দেশের জাতীয় মহিলা দলগুলোর কৃতিত্ব স্বরূপ দাবাড়ুদের ভূষিত করা হয় স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ পদকে। চূড়ান্তভাবে বিজয়ী দলের জন্য থাকে বিশেষ ট্রফি, যার নাম ‘ভেরা মেনচিক কাপ’।
৪৫তম দাবা অলিম্পিয়াডের আসর বসে ২০২৪ সালের ১০ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। টুর্নামেন্টের ৩য় রাউন্ডের ম্যাচে বার্বাডোসের লিশে স্প্রিংগারকে পরাজিত করেন রাণী। ম্যাচ জয়ী বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩ দশমিক ৫, অপরদিকে পরাজিত বার্বাডোসের পয়েন্ট ছিলো শূন্য দশমিক ৫।
এছাড়াও টুর্নামেন্টে পরপর ৬টি ম্যাচে একটানা জয় পান রাণী। অবশ্য গত শুক্রবার নবম রাউন্ডে বাংলাদেশ নারী দাবা দল হার মানে আর্জেন্টিনার কাছে। রাণী এককভাবে সারকিস মারিয়া বেলেনকে হারালেও বাকি তিন ডুয়েলে আর্জেন্টাইনদের সঙ্গে সুবিধা করে উঠতে পারেনি বাংলাদেশিরা।
এই আসরে দ্বীপরাষ্ট্র গার্নসির ৮৩ বছর বয়সী পোলিন উডওয়ার্ডের পরে রাণী ছিলেন দ্বিতীয় বর্ষিয়ান দাবাড়ু। তাই চেস কমিউনিটি থেকে তাকে ভালবেসে ‘দাদু’ সম্বোধন করা হয়।
দাবা খেলায় যাত্রার শুরু থেকেই প্রতিটা মুহূর্তে দাবার প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ ছিল রাণীর। বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নয়, বরং সবসময় খেলে গেছেন আনন্দ নিয়ে। খেলার প্রতি নিগূঢ় ভালোবাসার কারণে বয়সের বিষয়টি একদমি আমলে নেন না এই বয়স্ক দাবাড়ু। বরং প্রতিটি চাল দেওয়ার সময় তার উদ্দীপনা থাকে একদম তরুণদের মতোই। প্রতিপক্ষ কতটা শক্তিশালী বা অভিজ্ঞ তা নিয়ে কখনোই কোনো চিন্তা কাজ করে না তার মাঝে। তার ভাষ্যমতে, এমনও সময় গেছে যে, তিনি তার প্রতিপক্ষকে ঠিক করে চেনেনই না।
এই অর্জনগুলোর মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকজন তারকা দাবাড়ুদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছে রাণীর। এদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়ন সুসান ক্যাথরিন এবং হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার সুসান পোল্গারসহ আরও অনেকে। সম্প্রতি পোল্গার তার সঙ্গে একটি ছবি তুলে তা তার এক্স প্রোফাইলে শেয়ার করেন।
স্থানীয় মহসিন দাবা প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে ২০ বার জাতীয় নারী শিরোপা জয়। তারপর একে একে ব্রিটিশ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ, অলিম্পিয়াড, এবং কমনওয়েলথ স্বর্ণপদকপ্রাপ্তি। সব মিলিয়ে রাণী হামিদের এই দীর্ঘ যাত্রায় মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে দাবা খেলার প্রতি তার অগাধ ভালবাসা এবং অসামান্য দক্ষতা। এই অর্জনগুলোর উপরি পাওনা হিসেবে তিনি পেয়েছেন বিশ্বখ্যাত দাবা তারকাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক; বিশেষ করে দাবা কমিউনিটিতে ‘দাদু’ সম্বোধন। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের নারী দাবা উৎসাহীদের জন্য তার এই অভাবনীয় সাফল্য নিঃসন্দেহে এক বিরাট অনুপ্রেরণা।
আরো পড়ুন: শেষ টেস্ট খেলে দেশ ছাড়ার ইঙ্গিত সাকিবের

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top