ডেঙ্গু রোগীর ৫০ শতাংশই ঢাকার, এরপরেই রয়েছে চট্টগ্রাম-বরিশাল

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগীর ৫০ শতাংশই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। এরপর বেশি রোগী রয়েছে চট্টগ্রাম ও বরিশালে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে থাকে মানুষ। এ সময় ১২ জনের মৃত্যু হয় এবং ২ হাজার ৬৬৯ জন আক্রান্ত হয়। আগস্টে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এসময় ২৭ জন মারা যায় এবং ৬ হাজার ৫২১ জন আক্রান্ত হয়। চলতি মাসে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২৬ হাজার ৫৫৫ জনে পৌঁছেছে এবং মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৮ জনে।
১ জানুয়ারি থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত ১৩৮ জনের মধ্যে ৫২.২ শতাংশ নারী এবং ৪৭.৮ শতাংশ পুরুষ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ইউএনবিকে বলেন, ‘পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে যদি বিশেষ ব্যবস্থা না নেওয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা চাকরি বাঁচানো ছাড়া কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছে না। হেলাফেলা করায় প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে।দুই মাস আগে থেকে আমরা বলে এসেছি, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। কিন্তু কেউই পাত্তা দিল না। তারা স্বাভাবিক কার্যক্রম ছাড়া পিকের সময়েও পৃথক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রায় প্রতি বছরই ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনা করার জন্য একটি টিম গঠন করা হয়। ডেঙ্গুর প্রতিটি মৃত্যু পর্যালোচনা করে কীভাবে মৃত্যুর হার কমানো যায় সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই এ পর্যালোচনা করা মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এই মৃত্যু পর্যালোচনার রিপোর্টটি গবেষকদের হাতে বা নীতি নির্ধারণের হাতে কতটা পৌঁছায় তা আমার জানা নেই। অথচ এই তথ্য-উপাত্ত ভবিষ্যৎ ডেঙ্গুর রোগের মৃত্যুহার কমানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত।’
তিনি আরও বলেন, এখন দরকার হটস্পট ম্যানেজমেন্ট, সংক্রমণ ছড়ায়নি এমন জায়গায় মশার লার্ভা যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা নেওয়া এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। এটি নিশ্চিত করা গেলে রোগী কমে আসবে। এখন পুরো সেপ্টেম্বর তো বটেই সারাদশে অক্টোবরেও ভোগাবে।
হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ
ডেঙ্গু চিকিৎসা সামাল দিতে গিয়ে প্রতি বছরই বেগ পেতে হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার জন রোগী ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালটিতে। বর্তমানে চিকিৎসাধীন প্রায় ১০০ উপরে। যাদের অধিকাংশই রাজধানীর, মানিকনগর, বাসাবো, গোলাপবাগ, দক্ষিণ মুগদা, মিরপুরের বাসিন্দা ও মান্ডা এলাকার।
অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কভিড-১৯ হাসপাতাল এবং সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ একই চিত্র পাওয়া গেছে। এসব হাসপাতালে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী চাপ বাড়ছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ ইউএনবিকে বলেন, ডেঙ্গু যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে নির্দশনা দেওয়া হয়েছে। সার্বক্ষণিক তদারকি করে মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা বলেন, ‘যখনই ডেঙ্গু বাড়তে থাকে তখনই আমরা হইচই করি। নানারকম কার্যকলাপ দেখাই। কিন্তু, যদি গোড়া থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া থাকে, শুরু থেকে আমরা প্রত্যেকে সচেতন হই, তাহলে ডেঙ্গু সংক্রমণ হ্রাস পাবে।এছাড়া পাবে না।’
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুতে মৃত্যু সংখ্যা কম, এতে সন্তুষ্টি প্রকাশের কিছু নেই। সংক্রমণ হচ্ছে, এটাই আমাদের চিন্তার বিষয়। আমাদের এদিকে বেশি নজর দিতে হবে। সংক্রমণ রোধে দুইটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। একটা হলো চারপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, লার্ভা সাইডের মেডিসিন দেওয়া, ফগিং করা। আরেকটা হলো জনগণকে সচেতন করা।’
স্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, সারাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস ও লার্ভিসাইড স্প্রে করা হয়েছে ৯ হাজার ১০৬টি স্থানে। সারাদেশে গত বুধবার ১৮ হাজার ৭৩৩টি স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শন করা স্থানগুলোর মধ্যে ৫০৮টি সিটি করপোরেশন এলাকায় এবং ৭৪টি পৌরসভায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মশা নিধন অভিযান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সব সিটি করপোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ পৌরসভায় কাজ করছে ২ হাজার ৬৮৯ জন কর্মী।
চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের জরুরি সভায় ১০টি টিম গঠন করা হয়। যারা ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সাভার, দোহার, তারাব, রূপগঞ্জ ও অন্যান্য পৌরসভায় মশা নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সমন্বয় ও নিবিড়ভাবে তদারকি করছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ড. মুহ. শের আলী ইউএনবিকে বলেন, এডিস মশার লার্ভা বিনষ্ট এবং জীবন্ত ও উড়ন্ত মশা নিধনের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিতভাবে লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোশনের আওতাধীন এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর যে তালিকা পায়, আমরা সেসব রোগীর ঠিকানা অনুযায়ী বিশেষ মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করি।
অন্য দিকে উত্তর সিটি করপোরেশনে নগরবাসীর উদ্দেশ্যে ডিএনসিসির প্রশাসক ইউএনবিকে বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের তিনটি তদারকি টিম এবং ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ১০টি তদারকি টিম ১০টি অঞ্চলে প্রথম ধাপে সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত পরিচালিত লার্ভিসাইডিং এবং দ্বিতীয় ধাপে বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত পরিচালিত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০০০ সালে। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬ জন এ রোগে আক্রান্ত হন। এ সময় মারা যান ৮৫৩ জন। দেশের ইতিহাসে গত বছর ডেঙ্গুর সবচেয়ে ভয়াবহ সময় দেখেছে বাংলাদেশ। সোয়া ৩ লাখ মানুষ হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি ১ হাজার ৭০৫ মানুষের প্রাণহানি ঘটে ২০২৩ সালে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top