এক হাজারের বেশি ম্যাচ খেলে ৪০ বছর বয়সে অবশেষে চূড়ান্তভাবে বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বার্সেলোনার স্প্যানিশ কিংবদন্তি আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। পেশাদার ফুটবলের পাঠ চুকিয়ে এবার ক্যারিয়ারের পরবর্তী অধ্যায় শুরু করতে চান মাঝমাঠের এই জাদুকর।
মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি ভিডিও পোস্ট করে নিজের অবসরের ঘোষণা দেন এই প্রখ্যাত মিডফিল্ডার। তবে আজই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছেন না তিনি।
নিজের বিখ্যাত ৮ নম্বর জার্সির সঙ্গে মিলিয়ে আগামী ৮ অক্টোবর বিদায়ের ঘোষণা দেবেন এই ‘নাম্বার এইট’।
এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওর ক্যাপশনে তিনি লেখেন, ‘শিগগিরই আসছে ৮.১০.২৪।’
লিওনেল মেসি, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোদের যুগে ফুটবলে আবির্ভুত হয়ে গাদা গাদা গোল না করেও ফুটবল বিশ্বের বিরল সম্মান ও সমীহ অর্জন করেন ইনিয়েস্তা।
আরও পড়ুন: ২১ বছর পর ব্যালন দ’র লড়াইয়ে নেই মেসি-রোনালদো
মাত্র ১২ বছর বয়সে বার্সেলোনার লা মাসিয়া অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়ার পর ২০০২ সালের ২৯ অক্টোবর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ক্লাব ব্রুজের বিপক্ষে ১৮ বছর বয়সে ব্লাউগ্রানাদের জার্সিতে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় ইনিয়েস্তার। এরপর কাতালান জায়ান্টদের জার্সিতে বছরের পর বছর ধরে আলো ছড়িয়ে কিংবদন্তি হিসেবে বিদায় নেন তিনি।
২০১৮ সালের ২০ মে বার্সেলোনা ছাড়ার আগে তিনি ক্লাবটির হয়ে ৯টি লা লিগা, ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৬টি কোপা দেল রে, ৩টি উয়েফা সুপার কাপ ও ৩টি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপসহ মোট ৩২টি শিরোপা জেতেন।
বার্সেলোনার জার্সিতে মোট ৬৭৪টি ম্যাচ খেলে ৫৭টি গোল এবং ১৩৭টি অ্যাসিস্ট করেন এই মিডফিল্ডার।
এর মধ্যে ২০০৯ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে চেলসির বিপক্ষে একটি নাটকীয় গোল করে বার্সাকে ফাইনালে তোলেন তিনি। পেপ গার্দিওলার তত্ত্বাবধায়নে খেলা বার্সেলোনা সে বছর রেকর্ড ৬টি শিরোপা জেতে। এই বিরল সাফল্যের পেছনে ইনিয়েস্তার অবদান ছিল অসামান্য।
আরও পড়ুন: লিওনেল মেসির পর্যায়ে পৌঁছানো অসম্ভব: ইয়ামাল
ওই মৌসুমে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালের ব্যালন দ’রজয়ী লিওনেল মেসির পরই দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে তার নাম। এরপর ২০১২ সালে মেসি-রোনালদোদের পেছনে ফেলে ‘ইউরোপিয়ান প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার জেতেন এই খুদে জাদুকর।
বার্সেলোনা ছাড়ার পর ইনিয়েস্তা পাড়ি জমান জাপানে। সেখানে স্থানীয় ক্লাব ভিসেল কোবেতে যোগ দিয়ে ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত খেলেন এই তারকা। ভিসেল কোবের জার্সিতে ১৩৪টি ম্যাচ খেলে ২৬টি গোল ও ২৫টি অ্যাসিস্ট করেন তিনি। ইনিয়েস্তার নেতৃত্বে ২০১৯ সালে এমপেরর্স কাপ এবং পরের বছর জাপান সুপার কাপ জেতে কোবে।
২০২৩ সালের জুলাইতে জাপান ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্লাব এমিরেটস ক্লাবে পাড়ি জমান তিনি। তবে ২৩ ম্যাচে পাঁচ গোল করে পরের বছরের আগস্টেই ক্লাবটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন এই ফুটবলার।
জাতীয় দলের জার্সি গায়েও এই কিংবদন্তির অর্জন কম নয়। ২০০৮ সালে স্পেনের জার্সিতে ইউরো জেতার পর ভিসেন্তে দেল বস্কের কোচিংয়ে অনিন্দ্য সুন্দর ফুটবলের ডালি মেলে ২০১০ সালের বিশ্বকাপ জেতে ইনিয়েস্তার স্পেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচের শেষ মুহূর্তে জয়সূচক একমাত্র গোলটি করে জার্সি খুলে শূন্যে ঘোরানো তার সেই উদযাপনের কথা স্প্যানিশ ফুটবলভক্তদের হৃদয়ে আজও অমলিন।
২০১২ সালে স্পেন ফের ইউরো জিতলে টানা তিনটি আন্তর্জাতিক শিরোপাজয়ের বিরল কীর্তি গড়েন ইনিয়েস্তা। ওই টুর্নামেন্টেও তার অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখে দর্শক। ফলে ২০১২ সালের ‘ইউরোপিয়ান প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার ওঠে তারই হাতে।
জাতীয় দলের জার্সিতে ২০০৬ সালে অভিষিক্ত হওয়ার পর ১২ বছরে ১৩১ ম্যাচে মাঠে নেমে মোট ১৪ গোল ও ৩০টি অ্যাসিস্ট করেছেন এই ক্ষুদে জাদুকর। ২০১৮ বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় স্বাগিতক রাশিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলেন তিনি। ওই ম্যাচে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পাস দেওয়ার রেকর্ড গড়ে স্পেন। ১২০ মিনিটের খেলায় ১০১৪টি পাস দেয় তারা।
ক্যারিয়ারে মোট ১ হাজার ১৬টি ম্যাচ খেলে ১০৭ গোল ও ১৯১টি অ্যাসিস্ট করেছেন ইনিয়েস্তা। বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ইউরোর ফাইনালে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হওয়া একমাত্র ফুটবলার তিনি।
নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে ক্যারিয়ারে এমন সম্মান অর্জন করেছেন ইনিয়েস্তা, বিতর্ক-বিদ্বেষ ছাপিয়ে যা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। কাতালান ক্লাব বার্সেলোনায় খেললেও রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকদের সম্মান কুড়িয়েছেন তিনি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়ালের মাদ্রিদিয়ান ফুটবলারদের মুখেও অসংখ্যবার ঝরেছে তার প্রতি প্রসংশার বাণী।
ইনিয়েস্তাকে নিয়ে করা প্রশ্নে রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক অধিনায়ক ও ক্লাবটির কিংবদন্তি ডিফেন্ডার সের্হিও রামোস বলেছেন, ‘ইনিয়েস্তাকে নিয়ে কোনো হিংসা চলে না। ও আমাদের দেশের জন্য প্রথম বিশ্বকাপ নিয়ে এসেছে। এখানে (মাদ্রিদে) আমরা সবাই ওকে ভালোবাসি, সম্মানের চোখে দেখি।’
বার্সেলোনা ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে প্রতিপক্ষের মাঠ থেকেও একের পর এক ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ পেয়েছেন তিনি। ইতিহাসের খুব কম ফুটবলারই দলমত-প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বিশেষে ফুটবলভক্তদের অপার শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছেন। আর তা-ই করে দেখিয়েছেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা।